• 28 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 76 view(s)
  • APDR

প্রেস বিবৃতি : হাইকোর্টে এস এস সি র মামলায় ২৫৭৫৩ জনের চাকরি গেলো। এই রায় রাজনৈতিক - এই রায় ন্যায়বিচারের মূলনীতির পরিপন্থী



এস এস সি র নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে ২০১৬ সালের পুরো প্যানেলটাকে বাতিল করে সকলের (২৫৭৫৩ জন ) নিয়োগ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এর সাথে যারা অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন (প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও ওই প্যানেল থেকে , প্যানেলে নাম না থাকা সত্বেও এবং সাদা খাতা জমা দিয়েও যারা চাকরি পেয়েছেন) এযাবৎকাল পাওয়া সমস্ত বেতন চার সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিতে হবে ১২% সুদসহ । এছাড়াও তদন্ত চালিয়ে যাওয়া , প্রয়োজনে অভিযুক্তদের হেফাজতে নেওয়া। নির্বাচন শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা নির্দেশ দিয়েছেন। যোগ্য প্রার্থী যারা চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে গত চার বছর ধরে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের নাছোড়বান্দা লড়াই সমাজকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছে। সেই কারণে এই দুর্নীতির তদন্ত অত্যন্ত জরুরি ছিলো এবং প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি হওয়াটা এবং বঞ্চিতদের প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাওয়াটা গণতন্ত্রের পক্ষে প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এই রায় কি সত্যি সত্যিই গণতন্ত্রের পক্ষে গেলো , দুর্নীতিরোধের প্রবল আকাঙ্খা থেকেই কি এই রায় দেওয়া হলো ? ন্যায়বিচারের মূলনীতিগুলি মেনে নিয়ে কি এই রায় দেওয়া হলো ?

এই রায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতের নিরপেক্ষ উদ্যোগ নাকি রাজনৈতিক ভাবে চালিত হয়ে গেলো ?

সারা দেশে দুর্নীতির ফুলঝুরি ফুটছে , মধ্য প্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে বি জে পি সরকার যুক্ত এবং কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিই শুধু নয় , চল্লিশ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে কিন্তু সেই মামলায় অশ্বডিম্ব প্রসব হয়েছে , কর্ণাটকের বি যে পি নেতা খানি কেলেঙ্কারিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কোনো বিচার নেই। পশ্চিমবঙ্গের সারদা দুর্নীতিতে কয়েক লক্ষ মানুষ সর্বস্বান্ত কত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন কিন্তু ১২ বছর পরেও অভিযুক্তরা সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের কেউ কেউ তৃণমূল দল বদলে বি জে পি তে গেছে তাই মামলায় পিছুটান পড়েছে। নারদা মামলারও একই পরিণতি। এই মামলা শুরু হয়েছিল বঞ্চিত যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনে। এই রায়ে তাদের জন্য কোনো সুবাতাস নেই। সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা শেষ হতো ৮ ই মে। তার ১৫ দিন আগেই রায় বেরিয়ে গেলো এসএসসি র নিয়োগ মামলার। মূল চক্রান্তকারীদের একজনেরও শাস্তি ঘোষণা হয় নি। কিন্তু ওই প্যানেলে নিযুক্ত ২৫৭৫৩ জনেরই নিয়োগ বাতিল হয়েছে। সিবিআই এর রিপোর্টে ৪৬৮৯ জনের নিয়োগে রকমারি গরমিল ও বেনিয়ম হয়েছে আর বাকিদের সম্পর্কে কোনো বেনিয়মের অভিযোগ রিপোর্টে নেই। কোন দোষ প্রমাণ হয় নি তবু প্রায় ২০০০০ এর জনের চাকরি বাতিল হলো তাড়াহুড়ো করে দেওয়া এই রায়ে। রায় বেরোবার আগেই বিরোধী নেতা বোমা ফাটার উল্লাস দেখিয়েছিলেন। এই মামলার বিচার শুরু এবং গতি পেয়েছিল যার হাতে সেই বিচারপতি অভিজিতবাবু আজ বি জে পি র নির্বাচনী প্রার্থী। তাই এই রায়  ন্যায়বিচারের থেকেও অনেক বেশি রাজনীতি চালিত। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে বিষম বিপদের।

যা রায় দেওয়া হলো সেটাও কি ন্যায়বিচারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলো ?

এই রায়ে ২৫৭৫৩ জনের চাকরি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই প্যানেলে ২৫৭৫৩ জন যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের সকলের প্রাথমিক যোগ্যতা আছে। কিন্তু নিয়োগ পাওয়ার জন্য সব বিভাগের প্রাপ্ত নম্বর মিলিয়ে মোট নম্বরের ভিত্তিতে যোগ্যতার একটা ক্রম তালিকা থেকে ক্রমানুসারে নেওয়ার কথা । বিভিন্ন রকমের জালিয়াতি করে এই ক্রম তালিকা বিকৃত করা হয়েছে, তালিকার ক্রম না মেনে নিয়োগ হয়েছে, তালিকার বাইরে থেকে নিয়োগ হয়েছে। ৯-১০ এবং ১১-১২ শ্রেণীর শিক্ষক, গ্রুপ C এবং গ্রুপ D মোট  চারটি ক্যাটাগরিতে নিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ ১০ % এর কাছাকাছি। গ্রুপ D তে ৪৫ % আর গ্রুপ C তে ৩০% এর কাছাকাছি। আদালত তার পর্যবেক্ষণে এই নিযুক্তদের দুভাগে ভাগ করেছে। নিয়মবহির্ভূত এবং নিয়মমাফিক (valid). আদালত রায় দিয়েছে যারা বেআইনিভাবে চাকরি পেয়েছে তাদের বেতন ফেরত দিতে হবে সুদসহ।

তাহলে বাকি যারা আইনি (valid) ভাবে চাকরি পেয়েছেন তাদের নিয়োগ বাতিল করা হলো কোন যুক্তিতে ? এক্ষেত্রে যারা সবকিছুর মূলে তাদের সকলের শাস্তি দেওয়ার সাহস দেখাতে পারলে সমাজের উপকার হতো , এসএসসি র অসহযোগিতায় কারা যোগ্য আর কারা অযোগ্য তার তালিকা তৈরি করা যায়নি। আইনি (valid) প্রার্থীদের চাকরি যাতে না যায় তার জন্য কোর্ট নিজে নিরপেক্ষ কমিশন তৈরী করে সঠিক তালিকা তৈরী করার উদ্যোগ নিলো না কেন ? সমাজের দুর্বলতর মানুষকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের প্রথম শর্তই হচ্ছে অপরাধ প্রমাণ করতে না পারলে শাস্তি দেওয়া যাবে না। হ্যাঁ তাতে যদি দু একটি অপরাধীও ছাড় পেয়ে যায় তো যাবে। এতে তো আবেদনকারীদের চাকরি ও হবে না। ওদের বঞ্চনার কোনো সুরাহা হলো না। নতুন আরো একদল যোগ্য হওয়া সত্বেও চাকরি খুইয়ে পথে বসতে চলেছে। এতদিন পর আবার নতুন করে পরীক্ষা এবং সিলেকশন হলে এদের পক্ষে চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। রায়ের এই অংশ অবশ্যই বাতিল হওয়া দরকার তা নাহলে এই রায় নতুন বঞ্চনার কারণ হবে। 

এই দুর্নীতির সাথে যারা যুক্ত তাদের দুভাগে ভাগ করা যায়। মন্ত্রী, সরকার, আমলা, কমিশন, শাসক দলের ছোট বড় নেতা, এজেন্ট মিলে একটা দল।এরা পরিকল্পনা করে, সরকারি প্রশাসন, সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে অসৎ উপায়ে টাকা কামানোর জন্য এই অপরাধ সংগঠিত করেছে। এরা দুর্নীতির  উৎস , রূপায়ক মূল সুবিধাভোগী। এরা দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতি উপড়ে ফেলতে হলে এদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক রায় হওয়া উচিত ছিলো। এই কাজ সম্পূর্ণ হয় নি। এটাও সম্ভবত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই রায়দানের পর আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করা, অপরাধ প্রমাণ করা ও শাস্তি দেওয়া থমকে যাবে। আসল অপরাধীদের হয়তো কোনোদিন ছোঁয়াও হবে না।

উল্টোদিকে অন্য আরেক দল হলো যারা টাকা দিয়ে অথবা রাজনৈতিক প্রভাবে অযোগ্য হওয়া সত্বেও চাকরি পেয়েছেন। এরাও অপরাধে যুক্ত। এরা এই দুর্নীতির চালক না হলেও দুর্নীতির বাহক। এরা অযোগ্য হয়ে চাকরি করছে আর যোগ্যতা থাকা সত্বেও অন্যেরা রোদে জলে অনশনে। নীতিগতভাবে নিঃসন্দেহে এদেরও শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্ত এদের শাস্তি কি হবে সেটা ঠিক করার সময় বাস্তবতা বিচার করার দরকার। মনে রাখতে হবে এরা নিজেরাও দূর্নীতির শিকার। দুর্নীতি, ঘুষ দিয়ে সুবিধা নেওয়া আজকের দিনে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সোজা পথে, আইনিভাবে চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই রোগ দীর্ঘদিনের। তৃণমূল আমলে সেটা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে পুলিশের শীর্ষ কর্তা সবাই শাসকের আজ্ঞাবহ। শাসকদলের হাতেই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এই ধারণা ক্রমশ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। পাসপোর্ট নিতে গেলেও পুলিশকে টাকা দিতে হবে। মানুষের কাছ থেকে সৎ থাকার বিকল্প সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়ে অবৈধ ব্যবসার লাইনে দাঁড়ানোর বাধ্যতা তৈরি করা হয়েছে। তবু উচিত ছিলো সততার পথেই থাকা। যারা পারে নি তারা অপরাধী কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। এদের শাস্তিদানের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা আদালত না ভাবলে কে ভাববে।এদের চাকরি বাতিল হলো, বেতন ফেরত দিতে হবে, দরকারে গ্রেপ্তার করা হবে। শাস্তির বৃত্ত পূর্ণ। কিন্ত Electoral bond এর ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার রায় দিয়ে বলেছে এটা অসাংবিধানিক। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বন্ডে পাওয়া টাকা ফেরত দিতে বলে নি । যারা মূল অপরাধী তাদের শাস্তিদানের প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রেখে এদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক শাস্তি দেওয়াটা কতটা নৈতিক ?

অপরাধে যুক্ত শীর্ষ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার আগেই অপেক্ষাকৃত কম দোষীদের নজরকাড়া শাস্তি দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে ফিনিশিং টাচ দিয়ে ফেললো আদালত। বেঁচে গেলো বা বাঁচিয়ে দেওয়া হলো দুর্নীতির মূল মাথাদের। জুয়াখেলা অনৈতিক এবং অপরাধ। জুয়ার বোর্ডে হানা দিয়ে জুয়া খেলতে আসা লোকেদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ কিন্তু জুয়ার বোর্ড যারা চালায় তারা অধরা থেকে যায়। তাই জুয়াও বন্ধ হয় না। এক্ষেত্রেও একই নীতির পুনরাবৃত্তি।   

এস এস সি র নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির ঘটনা সামাজিক ভাবে ব্যাপক এবং গভীর। এই ঘটনায় যুক্ত রয়েছেন বহু মানুষ। এই মামলার রায় নিয়ে সমাজে গভীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে। তাই এই মামলায় আদালত সবদিক বিচার করে ন্যায়বিচার এবং সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে রায় দেবে এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু এই রায়ের সময়কাল, মূল বিষয়বস্তু এবং সামাজিক বাস্তবতা বিচার করে APDR এর দাবি :

) অবিলম্বে এই রায় বাতিল করে এই রায়ের প্রশাসনিক রূপায়ণের সিদ্ধান্ত রদ্ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

) অপরাধ প্রমাণ না করে কারো নিয়োগ বাতিল করা যাবে না। এটা অসাংবিধানিক এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

) আদালতের নিয়ন্ত্রণে একটা কমিশন করে নিয়মবর্হির্ভূত নিয়োগ চিহ্নিত করা হোক।

) এই দুর্নীতির সাথে যুক্ত মূল চক্রী যারা সেই মন্ত্রী, শাসক দলের শীর্ষনেতা , শীর্ষ আমলা কিংবা গ্রামে গঞ্জে যারা এজেন্টের কাজ করেছেন সেসব ছোট বড় নেতাদের মূল অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সময়সীমা বেঁধে তদন্তের ও বিচারের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।

) নিয়মভঙ্গ করে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে প্রমাণ হয়েছে তাদের শাস্তি হোক কিন্তু তাদের অপরাধের মাত্রা ও সামাজিক বাস্তবতা মাথায় রাখা হোক।

 

রঞ্জিত শূর,

সাধারণ সম্পাদক,

গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি ( এ পি ডি আর )

২৮/০৪/২৪


Eternal Vigilance is the Price of Liberty
All Rights Reserved APDR
About us | Contact Us